
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মুমতাহিনা করিম মীম যেন কোন গল্পের চরিত্র!
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জন্ম নেওয়া সাহসী তরুণী মীমের অবিস্মরণীয় সংগ্রাম
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এক প্রাচীন বাড়িতে জন্ম নেওয়া মুমতাহিনা করিম মীম যেন কোনো গল্পের চরিত্র। ছোটবেলার সেই মেয়েটির আঁকা ছবি দিয়েই শুরু হয়েছিল তার স্বপ্নের ক্যানভাস। আজ সেই ক্যানভাসে জ্বলজ্বল করছে যুক্তরাষ্ট্রের হেনড্রিক্স কলেজের ‘হ্যাস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’—একটি স্বপ্নযাত্রার সূচনা।
“আমার ঘরের দেয়াল ছিল আমার প্রথম ক্যানভাস,”—শুরুতেই বললেন মীম। “রাজকন্যা, প্রকৃতি কিংবা নিজের কল্পনার চরিত্র—প্রতিদিনই কিছু না কিছু আঁকতাম।”
মায়ের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল মীমের শিল্পের পথে যাত্রা। কিন্তু শুধু রঙ-তুলি নয়, প্রযুক্তির জগৎও তাকে টেনেছিল অন্যভাবে। ফ্রিল্যান্সিং করা মা যখন ল্যাপটপে কাজ করতেন, মীম সেখানেই খুঁজে পেলেন আরেকটি ক্যানভাস—*Microsoft Paint*। তারপর ক্লাস থ্রিতেই শুরু হলো তার কোড শেখা, ইউটিউবে দেখে HTML ও CSS শিখে ফেললেন। “প্রথমবার যখন ‘Hello World’ প্রিন্ট করি, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম—এই ট্যাপাট্যাপি করাটাও এক ধরনের শিল্প।”
তবে শুধু নিজে শেখাতেই থেমে থাকেননি মীম। নবম শ্রেণিতে স্কুলে প্রতিষ্ঠা করেন একটি প্রোগ্রামিং ক্লাব, যার শুরুটা হয়েছিল ৬৫ সদস্য নিয়ে। “প্রথমে অনেকে বলত, ‘এটা মেয়েদের কাজ না’, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম দক্ষতা আর ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে বড় পরিচয়।”
তাঁর এই আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতা ছড়িয়ে পড়েছিল রোবটিক্সেও। করোনাকালীন সময়টাতে ইউটিউব দেখে নিজেই বানান ছোট ছোট প্রজেক্ট। নিজের জমানো টাকায় কিনে ফেলেন আরডুইনো কিট, নানা সেন্সর। তাঁর ছোট রুমটাই একসময় হয়ে ওঠে ক্ষুদ্র ল্যাব, আর সেখানেই জন্ম নেয় তার তৈরি ফুড-সার্ভিং রোবট—‘কিবো’।
“আমার অনেক বন্ধুই বলত, ‘এসব করে সময় আর টাকার অপচয় করছো’। কিন্তু আমি এগুলো ভালোবেসেই করতাম,”—জানালেন মীম। “ভাবিনি, এই ছোট ছোট প্রজেক্টই একদিন আমার স্কলারশিপ পাওয়ার পথে সহায়ক হবে।” এইচএসসি পাসের পর যখন চারপাশের সবাই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ব্যস্ত, তখন মীম নিরবে প্রস্তুতি নেন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য। কোনো গাইডলাইন ছিল না, কোনো বড় ভাইবোন ছিল না। একা একা ঘাঁটতে ঘাঁটতে শিখে ফেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার নিয়ম, স্কলারশিপের ধরণ, স্টেটমেন্ট লেখার ধরন।
“পরিবারের কেউ কখনো বিদেশে পড়াশোনার কথা ভাবেনি। বরং অনেকে নিরুৎসাহিত করত, কেউ কেউ হাসতও। কিন্তু আমি জানতাম, ভালো স্কলারশিপ ছাড়া আমেরিকা যাওয়া সম্ভব না, তাই থেমে যাইনি,”—বললেন তিনি।
প্রতিদিন রাত জেগে SAT আর TOEFL-এর প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। নিজের হাত খরচ জোগাতে চাকরি নিয়েছিলেন এক মার্কিন কোম্পানিতে। কিন্তু রাত জাগার জন্যও শোনেন অনেক নেতিবাচক কথা। একসময় সব ছেড়ে পুরোপুরি মন দেন আবেদনে।
এই যাত্রায় পাশে ছিলেন একজন শিক্ষক—মিজানুর রহমান। “স্যার শুধু স্কুল-কলেজ নয়, SAT-ও পড়িয়ে দিয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ,”—কৃতজ্ঞতার কণ্ঠে বললেন মীম।
অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসে অফার লেটার। এর মধ্যে হেনড্রিক্স কলেজ তাঁকে দেয় পূর্ণ তহবিলের ‘হ্যাস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’। মীম এখন প্রস্তুত জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য।